আমরা তো এতদিন প্রাকৃতিক পাথতের কথা শুনেছি। কিন্তু বর্তমানে আমাদের শরীরেও একধরনের রোগের বাসা বাদছে। পিত্তথলি, কিডনি, অগ্ন্যাশয়ে এরোগটি হতে পারে। আমাদের দেশে কিডনি ও মূত্রথলির পাথরই বেশি লক্ষ করা যায়। এখানে আমরা কিডনি পাথর কি তা নিয়ে আলোচনা করব।
কিডনির পাথর কেন হয়?
গবেষনা চলছে যে এই রোগের কারন কি। তবে বর্তমানে গবেষকগন যেই ধারনা দিচ্ছেন তা হলো, প্রস্রাব অত্যধিক ঘন হলে পাথরের কণা বা ক্রিস্টাল এর সৃ্ষ্টি হয়। ডিহাইড্রেশন বা শরীর থেকে প্রতিনিয়ত পানি কমে যাওয়ার কারনে এটি হতে পারে।
পাথর তৈরির প্রধান কারণ ডিহাইড্রেশন বা পানি শুন্যতা। যাঁরা অতি গরমে বা উষ্ণ আবহাওয়ায় কাজ করেন এবং পর্যাপ্ত পানি পান করেন না, তাঁদের শরীরে পানির পরিমাণ কমে যায় এবং পাথর তৈরির আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই মরুভূমিতে, মধ্যপ্রাচ্যের গরম বা যেখানে অত্যধিক গরম পড়ে এমনকি আমাদের এই উপমহাদেশের অনেক জায়গায় বর্তমানে অনেক কিডনি পাথরের রোগী পাওয়া যায়।
আবার অনেক ক্ষেত্রে ধারনা করা হচ্ছে প্রস্রাবে একটানা অনেকবার সংক্রমন থেকেও পাথর হতে পারে। আমাদের শরিরে অনেক উপাদান আছে যা পাথর তৈরিতে বাধা দেয়। উপাদানগুলো হলো সাইট্রেট, ম্যাগনেশিয়াম, জিংক । এ উপাদানগুলো প্রস্রাবে কমে গেলেও কিডনিতে পাথর হতে পারে।
আবার শরীরে অনেক ধরনের উপাদান আছে যেগুলোর পরিমান মূত্রে বেড়ে গেলে কিডনেতে পাথর হতে পারে। যেমন: ক্যলসিয়াম , ইউরিক এসিড মূত্রে অতিরিক্ত পরিমানে নির্গত হলে কিডনিতে পাথর হতে পারে।
এছাড়াও প্রস্রাব নির্গত হওয়ার সময় বাধাগ্রস্ত হলে এবং মূত্রতন্ত্রে জন্মগত কোনো সমস্যা থাকলেও পাথর তৈরির শঙ্কা থাকে। প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থির অত্যধিক কার্যকারিহা বা টিউমার রক্তে ও প্রস্রাবের মধ্যে ক্যালসিয়াম বাড়িয়ে দিয়ে থাকে। এর ফলে দুই কিডনিতেই পাথর হওয়ার আশষ্কা থাকে। শিশুদের সিসটিনিউরিয়া এবং জ্যানথিনিউরিয়া কিডনি পাথরের কারন। পাথর কিডনিতে তৈরি হয়ে প্রস্রাবের নালি এবং মূত্রথলিতে নেমে আসে। যার ফলে প্রস্রাবে বাধা সৃষ্টি হয়।
জানা গেছে যে , অত্যাধিক পরিমাণে দুধ, পনির বা দুগ্ধজাত খাবার খাওয়ার অভ্যাসের ফলেও পাথর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
কিডনির পাথর এর লক্ষন কি?
কিডনির পাথর হওয়ার পর অনেকের ক্ষেত্রে লক্ষন প্রকাশ নাও পেতে পারে। মেরুদন্ডের ব্যথার জন্য চেক-আপের সময় কিডনির পাথর ধরা পড়তে পারে। আবার অনেক সময় কিডনির পাথরের জন্য ব্যথা হলে ওপরের পেটের অথবা নিচের পিঠের ডানে বা বাঁয়ে মাঝে মৃদু ব্যথা হতে পারে।
লাল বর্নের প্রস্রাব বা প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া কিডনি পাথরের অন্যতম কারন। আবার পেটে প্রচন্ড ব্যাথা , বমি এবং সাথে জ্বরও হতে পারে। পাথর মূত্রনালি বা ইউরেটারে আটকে গেলে কিডনি ফুলে যায়। অনেক সময় ইউরোসেপসিস বা মারাত্মক সংক্রমণ হয়ে জীবনের শংকা দেখা দিতে পারে। এসব ক্ষেত্রে খুব দ্রুতভাবে ইউরোলজিস্টের পরামর্শ নিয়ে পাথর বের করতে হবে এবং ডাক্তারের পরার্মশ নিতে হবে।
কিডনি ও মূত্রতন্ত্রের পাথর শনাক্ত করার পরীক্ষা
কিডনি পাথরের জন্য রোগীর প্রস্রাব পরীক্ষা করলে লোহিতকণিকা, পাস-সেল বা পাথরের ক্রিস্টাল পাওয়া যেতে পারে। পেটের এক্স-রে করলে প্রায় ৯০ শতাংশ পাথর দেখা যায়। তবে সবথেকে কার্যকরি পদ্ধতি হলো সিটি স্ক্যান । আলট্রাসনোগ্রাম করলেও কিডনি ও মূত্রথলির পাথর ধরা পড়ে।
কিডনির পাথর এর চিকিৎসা কি?
কিডনির পাথরের চিকিৎসা মূলত পাথতের পরিমাপ অনুযায়ি করা হয়ে থাকে অনেক ক্ষেত্রে। কিডনির পাথরের পরিমাপ যদি ৪ মিলিমিটার বা এর থেকে ছোট হয় তাহলে ৯০% সম্ভাবনা থাকে যে, পাথরটি প্রস্রাবের সাথেই বের হয়ে যাবে। এজন্য রোগীর বেশি পরিমান পানি পান করতে হবে। যদি ব্যথা থাকে তাহলে ব্যথার ঔষধ খেতে হবে। আর সবথেকে ভালো হয় যদি প্রতি সপ্তাহে এক্স-রে বা সিটি স্ক্যান করে দেখা হয়। এর ফলে পাথরের অবস্থান এবং পাথরটি বেরিয়ে গেছে কিনা তা দেখা বা বুঝা যাবে।
কেউ চিকিৎসা চলমান অবস্থায় ছাঁকনি জাতীয় কিছুতে প্রস্রাব করে তবে পাথরটি বের হলে ধরা পড়ে। আবার পাথর বের হওয়ার সময় রোগীরা বুঝতে পারেন যে প্রস্রাবের সাথে কিছু একটা বের হচ্ছে এবং টয়লেটের কমোডের নিচে জমা হয়। কিন্তু কোনাক্রমে যদি পাথরটি মূত্রনালিতে আটকা পড়ে তবে পাথরটি ছোট হলেও তা অপসারনের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে প্রস্রাবে বাধা হয়ে আরও অনেক ধরনের ক্ষতি করতে পারে।
পাথরটি যদি .৫ থেকে ২ সেন্টিমিটার আকারের হয়ে থাকে এবং সুবিধামতো স্থানে থাকে তবে বাইরে থেকে শক্ ওয়েভ দিয়ে তা গুড়া করে প্রস্রাবের সাথে বের করা সম্ভব । কিডনি থেকে ছোট আকারের পাথর অপসারনরক বলা হয় মিনিম্যাল ইনভেসিভ পদ্ধতি হলো আরআইআরএস (রেট্রোগ্রেড ইন্ট্ররেনাট সার্জারি)। এই পদ্ধতিতে প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে ফেক্সিবিল ইউরেটেরোস্কোপ দিয়ে কিডনিতে পৌঁছে লেজারের মাধ্যমে পাথর গুঁড়া করে বের করে আনা হয়।
তবে সবথেকে কার্যকর পদ্ধতি হলো পিসিএনএল। এই পদ্ধতিতে পিঠের দিক দিয়ে ছোট একটি ছিদ্র করে যেকোনো আকারের এবং পৃকিতির পাথর বের করে নিয়ে আসা যায় ১০০% নিশ্চয়তার সাথে। উন্নত বিশ্বে এইভাবেই কিডনির পাথর অপসারন করা হয়। বাংলাদেশেও এই পদ্ধতি চালু রয়েছে। সম্পূর্ন ব্যথা মুক্ত এই পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে রোগীকে অজ্ঞান করতে হয়না। এখন আর পেট কেটে কিডনি পাথরের সার্জারি করা হয় না বললেই চলে। তাই রোগীকে পুরো অজ্ঞান করার প্রয়োজন হয় না এবং দুদিনেই বাসায় ফিরে যেতে পারেন।
কিডনির পাথর প্রতিরোধের উপায় ও করনীয় :
কিছু কাজ আছে যা নিয়মিত করার ফলে কিডনির পাথর থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। খাদ্যাবাস এবং নিয়মিত পরিমান মতো পানি পান করলে অনেকাংশে এই রোগ হতে রক্ষা পাওয়া যায়। অনেকের একবার পাথর হলে আবার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই যারা পূর্বে কিডনির পাথরে আক্রান্ত হয়েছে তাদের সতর্ক থাকতে হবে।
আপনার কতটুকু পানি প্রয়োজন তা নির্ভর করে আপনার পরিবেশের উপর উপর এবং আপনি কোন ধরনের কাজ করেন তার উপর। যদি গরমে কাজ করেন তাহলে আপনাকে অধিক পরিমানে পানি পান করতে হবে। কেউ যদি মাঠে কাজ করেন তাহলে তার পানি পান করার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
যাঁদের আগে পাথর হয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রে সাধারণত এমন পরিমাণ পানি ও তরল পান করতে হবে যাতে করে প্রস্রাব ২৪ ঘণ্টায় ২ লিটারের মতো হয় অথবা প্রস্রাব উচ্চবর্ণের না হয়। এটি দেখতে যেন অনেকটা পানির মতোই হয়। আপনার পরিবেশ বেধে ২-৪ লিটার পান করার প্রয়োজন হতে পারে।
যদি প্রস্রাবে কোনো কারনে বাধা হয় তাহলে তার সঠিক চিকিৎসা করতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।খাবারে লবনের পরিমান কমাতে হবে।
মূত্রতন্ত্র বা কিডনি থেকে পাথর বের করার পর তা পরিক্ষা করতে হবে ল্যাব এ। ক্যালসিয়াম অক্সালেট পাথরের ক্ষেত্রে যেসব খাদ্যে অক্সালেট বেশি থাকে তা কম খেতে হবে। যেমন, পালংশাক, স্ট্রবেরি, মাখন, চকলেট, দুগ্ধজাতীয় খাবার। প্রস্রাবে সাইট্রেট কম থাকলে পটাশিয়াম সাইট্রেট খেতে হবে। এটি প্রস্রাবে অ্যাসিডোসিস কমায়। অজ্ঞাত কারণে প্রস্রাবে ক্যালসিয়াম বেড়ে গেলে মূত্রবর্ধক থায়াজাইডজাতীয় ওষুধ দেওয়া যেতে পারে। ইউরিক অ্যাসিড থেকে যদি পাথর হলে লাল মাংস খাওয়া কমাতে হবে।প্রস্রাবের বেগ পেলে সাথে সাথে প্রস্রাব করার চেষ্টা করতে হবে। প্রস্রাব আটকে রাখার চেষ্টা করবেন না।প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি জাতীয় খাবার খেতে হবে। তবে অতিরিক্ত পরিমানে ভিটামিন সি এবং ভিটামিন ডি পরিহার করতি হবে।প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
সতর্কতা: বর্তমানে অনেকেই ভুল ধারনা দিয়ে থাকেন যে অনেক ঔধধের মাধ্যমে পাথর গলিয়ে বের করে ফেলা যায়। তবে এমন কোনো ঔষধই এখন পর্যন্ত ১০০% কাজ করতে সক্ষম হয়নি। তাই ভুল চিকিৎসা না নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ি চিকিৎসা নিতে হবে।