বাংলাদেশের ইতিহাসের সবথেকে ভয়ংকর একটি ঘটনা হলো অপারেশন সার্চলাইট । ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি হঠাৎ ঢাকা শহরের ঘুমন্ত নিরহ মানুষের উপর গনহারে অত্যাচার শুরু করে। এতে অনেক নিরহ মানুষ শহীদ হন। বেজে উঠে যুদ্ধের ঘন্টা।
১৯৭০ সালে গঠিত হওয়া অপারেশন ব্লিটজ এর অনুষঙ্গ হিসেবে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা এই নির্মম অত্যাচার শুরু হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চেয়েছিল এই অত্যাচার, নিপিড়ন মাধ্যমে বাঙালিদের দমন করতে।
এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা হয়। বাংঙালিদের প্রতিরোধ পাকিস্তানের ধারনার বাইরে ছিল। ওরা মনে করেছিল যে, বাঙালিদের উপর অত্যাচার শুরু করলে ওরা হার মেনে নেবে কিন্তু বাঙালিরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে পাকিস্তানি হানাদারদের সাথে যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অর্জন করে গৌরব উজ্জল বিজয়।
অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালিদের জয়ই ছিল মূল কারন। কিন্তু তারা শুরু থেকেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে দেয়নি। তারা নানা বাহানার মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে রেখেছিল। বাঙালিরা ৬ দফার মাধ্যমে তাদের কাজ সামনের দিকে অগ্রসর করতে চেয়েছিল।
জুলফিকার আলি ভুট্টো বলেছিলেন যে, বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেনা। তিনি বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা কমানেরা জন্য অনেক ষড়যন্ত্র শুরু করেন। পরবর্তিতে ৭ই মার্চের সফল সমাবেশের পর যখন বাঙালি তার স্বাধীনতার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে তখনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিভিন্ন পরিকল্পনা শুরু করেন বাঙারিদের প্রতিরোধ করার জন্য।
মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারিতে সামরিক বাহিনীর একটি সমাবেশে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা করা হয়।
পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি লে জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এস এম আহসান পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের উপর সামরিক হামলার বিরোধী ছিলেন বলে অপারেশনের পূর্বেই তাদেরকে দায়িত্ব হতে অব্যাহতি দেয়া হয়।
লে জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর ও জিওসি করে পাঠানো হয়। ১৮ মার্চ সকালে ঢাকা সেনানিবাসের জিওসি কার্যালয়ে বসে জেনারেল রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি অপারেশনের পরিকল্পনা তৈরি করেন।
২৫ মার্চের রাতের শেষ প্রহরে ঢাকায় এবং অন্যান্য গ্যারিসনকে ফোন কলের মাধ্যমে তাদের জিরো আওয়ারে তাদের কার্যক্রম শুরু করার জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়। রাও ফরমান আলি ছিলেন ঢাকার সৈন্যদের নেতৃত্বে এবং জেনারেল খাদেম ছিলেন অন্যান্য স্থানের সৈন্যদের কমান্ডে।
গৃহীত সিদ্ধান্ত সমূহ
পাকিস্তানিদের অনেকগুলো পরিকল্পনা মাথায় রেখে তারা নারকীয় হত্যাকান্ড শুরু করে। যার মধ্যে ছিল সংখ্যা লঘুদের হত্যা, সামরিক শাসন থাকা কালীন যারা আওয়ামী লীগকে সমর্থন যুগিয়েছে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া।
সাফল্যের নিয়ামকগুলো
- একযোগে পুরো দেশে অপারেশন সার্চলাইট সংঘটিত হওয়া।
- ঢাকায় অপারেশন শতভাগ সফল হতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল এবং ছাত্রদের তল্লাশি এবং গ্রেফতার।
- টেলিফোন , টেলিভিশন, রেডিওসহ সকল আন্তযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া।
- নেতা , ছাত্রসহ উপরস্থ সকল লোকদের গ্রেফতার।
অপারেশন সার্চলাইটের সময়কাল ছিল ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত। এসময় তারা তাদের পরিকল্পিত হত্যাকান্ড পরিচালিত করে।
অপারেশন সার্চলাইটের আওতায় ২৫ মার্চ রাতের অভিযানে প্রকৃত হতাহতের হিসাব পাওয়া যায় না। বিদেশি সাংবাদিকদের ২৫ মার্চ অভিযানের আগেই দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। দেশি সংবাদপত্রের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকায় এ সম্পর্কে তেমন বিশেষ কিছু জানা যায় না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লুকিয়ে থাকা তিন বিদেশি সাংবাদিক আর্নল্ড জেটলিন, মাইকেল লরেন্ট, সাইমন ড্রিং-এর লেখনী থেকে সে রাতের ভয়াবহ নৃশংসতা সম্পর্কে জানা যায়।
সাইমন ড্রিং ‘ডেটলাইন ঢাকা’ শিরোনামে ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ২১ মার্চ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তাতে ইকবাল হলের ২০০ ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় শিক্ষক ও তাদের পরিবারের ১২ জন নিহত হওয়ার সংবাদ পরিবেশিত হয়। পুরনো ঢাকায় পুড়িয়ে মারা হয় ৭০০ লোককে। দেশি বিদেশি বিভিন্ন সূত্র থেকে যে বিবরণ পাওয়া যায় তাতে ওই রাতে শুধু ঢাকায় ৭ হাজার বাঙালি নিহত হয়। [আবু মো. দেলোয়ার হোসেন]